নারায়ণ দেব
বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব
নাট্য আলোচনাঃ " বিদ্যারম্ভে" এবং " অরণ্য সংবাদ"
নাট্যোৎসবের একাদশ সন্ধ্যার প্রথম পরিবেশনা ছিল নাটকঃ " বিদ্যারম্ভে"। রচনাঃ বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়। সম্পাদনা ও নির্দেশনাঃ জয় শংকর ভট্টাচার্য। উপদেষ্টাঃ,উত্তম সাহা। পরিবেশনাঃ পটভূমি, আগরতলা।
নাটকটি দেখতে দেখতে ভবানী প্রসাদ মজুমদারের একটি ছড়া মনে পড়ে যাচ্ছিল। যার প্রথম দুইটি পংক্তি হল " ছেলে আমার খুব সিরিযাস, কথায় কথায় কথায় হাসে না/ জানেন দাদা, আমার ছেলের, বাংলাটা ঠিক আসে না।"
বর্তমান সময়ে মধ্যবিত্ত বাঙালী পরিবারের অধিকাংশ মা বাবার এই এক ট্রেন্ড। ছেলে মাতৃভাষা বলতে না পারাটা যেন গর্বের ব্যাপার। যেন তেন প্রকারেন সন্তান সন্তদিদের ইংলিশ মিডিয়ামে ভর্তি করার প্রানান্তকর প্রচেষ্টা। হাস্যকর ভাবে ইংরেজী কায়দা রপ্ত করার এক বিকৃত প্রয়াস।
" বিদ্যারম্ভে" নাটকটিতেও আমরা তার প্রতিফলন দেখতে পাই। বাতের ব্যাথায় কাতর স্ত্রী, দুই পুত্র, এক পুত্রবধু ও নাতিকে নিয়ে সুখের সংসার আশুতোষ বাবুর। নাতি জয় দাদু ঠাকুমার কাছে থাকতে ভালবাসে। দাদু নাতি জয়কে প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার পাশাপাশি জীবনের পাঠ দেন। ব্যাপারটা পুত্রবধু মণিকার না পসন্দ। সে ছেলেকে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করাবেই এবং করায়ও। পরবর্তীতে বিভিন্ন বাস্তব ঘটনায় তার বোধোদয় ঘটে।
মেদহীন স্ক্রিপ্ট, প্রায় নিঁখুত অভিনয় আর দোলা লাগানো এক সহজ সরল পরিবেশনা সমগ্র নাট্যটিকে সাফল্যের শীর্ষে নিয়ে যায়। বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের স্ক্রিপ্টটিকে এক নিটোল চেহাড়ায় মঞ্চে উপস্থাপিত করেছেন নির্দেশক জয় শংকর ভট্টাচার্য। ফলে মনে রাখারর মত বিভিন্ন নাট্য মুহুর্ত রচিত হয় দৃশ্যে দৃশ্যে। তার কাজে পাওয়া গেল মননশীলতার নিদর্শন।
সঙ্গীত রচনায় সৌমেন্দ্র নন্দী এক মনোমুগ্ধকর আবহ তৈরি করেন। সুজিত সরকারের আলো প্রযোজনার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ। তবে শেষ দৃশ্যে এরোপ্লেনের শব্দের সঙ্গে সাযূয্য রেখে আলো সম্পর্কে একটু অন্য রকম চিন্তা ভাবনা করাই যেত। দীপঙ্কর বর্ধন রায়ের মঞ্চ ভাবনা রাজেশ কান্তি রায়ের নির্মাণ নাট্যচলনকে সাহায্য করেছে সঠিক ভাবে। মুকুল রায়ের রূপটান চরিত্রগুলিকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে।
অভিনয়ে প্রত্যেকে এত একনিষ্ঠ যে, মঞ্চ থাকে
সদা জীবন্ত। আশুতোষের চরিত্রে উত্তম সাহা ছিলেন অনবদ্য। শরীরী ভঙ্গীতে, সংলাপ উচ্চারণে তিনি চরিত্রটির বিভিন্ন ভাবকে দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন। শান্তিময়ীর চরিত্রে সুমিতা ভৌমিকের অভিনয় দীর্ঘ দিন দর্শকের মনে থাকবে। হাটা চলায় বাতের ব্যাথার কাতরতা প্রকাশের পাশাপাশি বাচিক অভিনয়ে তিনি ছিলেন যথেষ্ট যত্নবান। মনিকা চরিত্রে তুষ্টি রায় চৌধুরির কাজটিও ভালো লাগে। সহজ সরল গৃহবধু থেকে হঠাৎ আধুনিকা হয়ে উঠার ভাবটি তিনি চমৎকার ভাবে প্রস্ফুটিত করেছেন তার অভিনয়ে। শৈলেন চরিত্রটিকে রূপ দিতে সুমন মজুমদার আন্তরিক ভাবে চেষ্টা করেছেন। অনেকাংশে সফলও হয়েছেন। কিন্তু সারাক্ষণ চোখমুখ কুচকে রাখার ব্যাপারটা তাকে পরিহার করতে হবে। শিবেন চরিত্রে পিযূষ দাস খানিকটা নিষ্প্রভ ছিলেন। রিক্সাওয়কলা চরিত্রে অভিনয় করেছেন পরিচালক জয় শংকর ভট্টাচার্য নিজে। পরিচালনার দিকে নজর দিতে গিয়ে তিনি নিজের চরিত্রটির দিকে সঠিক বিচার করতে পারেন নি। দেশওয়ালী ভাষাটার দিকে একটু নজর দিলে চরিত্রটি সর্বাঙ্গ সুন্দর হবে। ভালো লাগে জয় চরিত্রে ছোট্ট মৃন্ময় রায়কে। জয়ের মতন ছোট্ট শিল্টীরাইতো নাটকের আগামি প্রজন্ম।
পরিশেষে বলা চলে বিষয় ভাবনা এবং নাটকের সমস্ত উপাদানের সুন্দর মিশ্রনে সমগ্র প্রযোজনাটি দর্শকের নিকট উপভোগ্য হয়ে উঠে।
একাদশতম সন্ধ্যার দ্বিতীয় প্রেক্ষণ ছিল নাটকঃ
" অরণ্য সংবাদ"। রচনাঃ শিবংকর চক্রবর্তী। নির্দেশনাঃ পিযূষ কান্তি দেব। পরিবেশনাঃ কবিতালোক, আগরতলা।
সাম্প্রতিক কালে আমাদের প্রতিবেশী রাজ্য পশ্চিম বঙ্গের একটি ঘটনায় আমাদেরকে নারিয়ে দিয়েছে। আরজি কর হাসপাতালে যে নারী ধর্ষিতা হলেন, এবং তাকে কেন্দ্র করে যে মেডিক্যাল স্ক্যাম সামনে আসতে শুরু করেছে তা সত্যিই স্তম্ভিত করে দেয় আমাদেরকে। শুধু মাত্র প্রশাসন, বিচার ব্যবস্থ্যা, বিক্ষোভ আন্দোলনে শিকড় গেড়ে বসা এই ব্যাধিকে নির্মূল করা সম্ভব নয়। যদি না চিকিৎসা ক্ষেত্রের যারা মূল কারিগর অর্থ্যাৎ ডাক্তার বাবুরা, তারা না এগিয়ে আসেন। এবং এমনি এক ডাক্তারের সন্ধান পাই আমরা "অরণ্য সংবাদ" নাটকে। ডাঃ অরণ্য মুখার্জী ঋজু শিরদাঁড়ার একটি মানুষ।যিনি আশ্রয় দিয়েছেন অসহায় তাপসীকে। শত প্রলোভন এবং বদনামের ভয় উপেক্ষা করে অণ্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন তিনি। তাপসীকে দত্তক নিয়ে তাকে দিয়েছেন সম্মান। এমন একটি নির্লোভ, সত্যনিষ্ঠ, প্রতিবাদী মানুষ নয় আরও শত শত মানুষর বড়ই প্রয়োজন এই সময়ে।
নাটক সময়কে ধারন করে এই চিরন্তন সত্যকে আবারা প্রমান করল কবিতা লোকের এই নাটক নির্বাচন। যা এই সময়ের এক সঠিক চয়ন।
নাট্য কাহিনীকে অনুসরন করে পুরো নাটকটিকে সাজিয়েছেন নির্দেশক পিযূষ কান্তি দেব। তিনি কোন গিমিক ছাড়াই চরিত্রগুলোকে মঞ্চে হাজির করেন যথাযথ ভাবে। যার ফলে সমগ্র নাট্য প্রযোজনাটি হয়ে উঠেছে একটি মেদহীন, ছিপছিপে পরিবেশনা। পিযূষের কাজে পাওয়া গেল এক অন্তর্লীন ছন্দ।
নাটকের আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো প্রদীপ দাসের মার্জিত আলোর প্রয়োগ। সৌমেন্দ্র নন্দীর আবহ নির্মাণ আবারও তার বিশ্বস্ততা প্রমান করল। অলক চক্রবর্তীর মঞ্চ ভাবনা এবং রাজেশ কান্তি সাহার নির্মাণ নাট্যানুসারী। তবে মঞ্চের পরিসরটি আরেকটু ছোট করে নিলে কুশিলবদের মঞ্চে চলাচলের সুবিধা হবে।
রূপা নন্দীর রূপসাজ প্রসংসার দাবি রাখে।
এবার আসা যাক অভিনয়ের কথায়। ডাক্তার অরণ্য মুখার্জীর চরিত্রে অরিজিৎ বণিক আশ্চর্য কাজ করেছেন। তিনি যে অভিনয় করেছেন বোঝা যায় না। এতটাই চরিত্রের ভেতর অবগাহন করেছেন তিনি। পাশাপাশি প্রশান্ত দত্ত চরিত্রে দেবাশিস দেও ভীষণ স্বতঃস্ফুর্ত। তার চলন বলন চরিত্রটিকে বিশেষত্ব দিয়েছে। তাপসীর ভূমিকায় সুপর্ণা দেবনাথকে সাবলীল লেগেছে। মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ চরিত্রে অতনু চন্দ এবং গকুল চরিত্রে প্রবাল ব্যানার্জীর কাছ থেকে আরেকটু কুশলী অভিনয়ের প্রত্যাশা রইল। এছাড়া রতন চরিত্র অভিনয় করেন রাজু মোদক।
বিষয় ভাবনা এবং নাট্য নির্মাণের সমস্ত বিভাগের সুষম প্রয়োগে নাট্যটি আলো জ্বেলে যায় দর্শক
চেতনায়।