img

নাট্য আলোচনা "হরগৌরির সংসার", "ওথেলো রিটার্নস" ও "কে বলে কেউ নেই"

কমল মজুমদার
বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব
ত্রিপুরা সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তর আয়োজিত নাট্য উৎসব ২০২৪এর ত্রয়োদশ সন্ধ্যায় তিনটি নাটক মঞ্চায়ন হয়েছে। এর প্রথম নাটক ধর্মনগরের অঙ্কুর দলের "হরগৌরীর সংসার" । নাট্যকার রঞ্জিত  পুরকায়স্থর লেখা ও উনার নির্দেশনায় নাটক। আমাদের গ্রামীণ সংস্কৃতির একটি উৎসব যেটা চৈত্র সংক্রান্তিতে হয় চড়ক মেলা সেই উৎসবের প্রসঙ্গ টেনে এই নাটক।বর্তমানে আমাদের সংসার যা এখনও যারা এই সংস্কৃতির সাথে জড়িত জড়িয়ে আছে তারা ভীষণভাবেই উপেক্ষিত সমাজের কিছু শ্রেণির কাছে নিচু জাত বা দলিত বলেই বিবেচিত হয়। অথচ তারা কিন্তু সবার মঙ্গল কামনাই করে। কিন্তু বর্তমান সমাজ তাও তাদের সব সময় তুচ্ছতাচ্ছিল্য ভাবেই দেখে।এর থেকে উত্তরণের কোন উপায় নাট্যকার দেখাতে পারেননি। উপরন্ত উনি  মনে হয় ব্যাপারটা দর্শকদের  বা সমাজের উপরেই ছেড়ে দিয়েছেন।সেই ক্ষেত্রে নাটকে হরকুমার সুত্রধর নিজের চরিত্র ভালোভাবে ফুটিয়ে তুললেও উনার স্ত্রীর ভূমিকা দুর্বল মনে হয়েছে। এছাড়া ঋষিতা পুরকায়স্থ, পৌলোমি চৌধুরী,নির্ঝর পাল,রীত দেব, বাবলা শব্দকর ও প্রশান্ত দত্ত মোটামুটি ভাবে তাদের অনুযায়ী তারা অভিনয় করে গেছেন।বাদকের কিছুটা জায়গা অতিরিক্ত আওয়াজের ফলে কথা বা অন্যদের গান শোনা যায়নি। মোটামুটি ভাবে চলন সই অভিনয় করে গেছেন । মঞ্চে যথাযথ আলো নিয়ে আরেকটু চিন্তা ভাবনা করা উচিত। এখানে আলোক শিল্পী, মঞ্চ শিল্পী ও রূপসজ্জাশিল্পী আলাদা করে কোন নাম না থাকাতে আমার বুঝতে অসুবিধা হয়েছে,কে এই দায়িত্ব গুলো পালন করেছিলেন। নির্দেশকের প্রতি অনুরোধ রইল পরবর্তী শোতে আরেকটু এদিকে নজর দেওয়ার।

দ্বিতীয় নাটক উদয়পুর  অভিমুখ নাট্য দলের নাটক "ওথেলো রিটার্নস"। অভিজিৎ দাস ও সুমন মজুমদার তাদের শেক্সপিয়ারের  একটি ট্র্যাজেডি নাটক ওথেলো নাটকটিকে নিজের মতো করে ডিজাইন করেছেন।তাদের নিজেদের মতো করে ২০২৪ সালের ওথেলো এখন কি রকম হতে পারে সেই ভাবনাটাই নাটকের মধ্যে তুলে ধরেছেন ।এই ওথেলো নাটক আমরা যতটুকু জানি সবটাই সন্দেহ বসে কি হয়ে যায় কিভাবে ধ্বংস হয় সেই রূপটাই আমরা  দেখেছি। কিভাবে সন্দেহের বসে নিজের স্ত্রীকে খুন করেছে এবং যখন সে বুঝতে পারল যে তার স্ত্রী নির্দোষ তখন সে নিজেই আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। যাই হোক অভিজিত এই নাটকে তার নিজের ভাবনাকে তুলে ধরেছে সেই অর্থে সে সফল।ধর্মনগর ও মেলাঘরের একজন করে শিল্পী কে অভিনয় করিয়েছে এটা ওদের খুব ভালো দিক।উদয়পুরের শিল্পী আছে অনেক এবং ধর্মনগর থেকেও শিল্পী নিয়ে অভিনয় করিয়ে সম্মিলিতভাবে নাটকের মঞ্চে তুলে মোটামুটি ভাবে সফলতা পেয়েছে । এছাড়া পীযূষ দাস,আকাঙ্ক্ষা ভট্টাচার্য্য, অভিজিৎ দাস,সুমন মজুমদার,অনির্বাণ ভালই তাদের নিজস্ব পারদর্শিতা দেখিয়েছে।অভিজিৎ তার নিজের কিছু শব্দ দর্শকদের শোনাতে পারেনি  কারণ  কণ্ঠস্বর নিচু ছিল। অন্যান্য শিল্পীরা তাদের মত করে অভিনয় করে গেছে । এছাড়া আলোতে অনেক ডিস্টার্ব হয়েছে,কোথাও  অতিরিক্ত অপ্রয়োজনীয় জ্বলেছে আবার নিভেছে।সেদিকেও পরবর্তী সময়ে নির্দেশককে নজর দেওয়ার জন্য অনুরোধ রইল। আলো:-নন্দন দেব, রূপসজ্জা - পীযুষ দেব ,মঞ্চ ও আবহ - অভিজিৎ দাস। 


সন্ধ্যার তৃতীয় নাটক "কে বলে কেউ নেই"। নন্দন তৃষা নাট্য গ্রুপের নাটক "কে বলে কেউ নেই "।ননী দেবের পরিচালনায় নাটকটি মঞ্চায়ন হয়েছে। নাট্যকার সুহাশ দত্ত উনার সাধারণ বিষয়টিকে অসাধারণ ভাবে তুলে ধরেছেন ।আসলে  নাট্যকার আমাদের বর্তমান  সমাজ বিভিন্ন রোগে  ভুগছে, সেটাকেই এখানে তুলে ধরেছেন। একটা ছেলে তার নিজের পড়াশোনা মনে থাকে না অথচ বাবা-মা চেষ্টা করে যাচ্ছে কিন্তু এতে করে কোন লাভ হচ্ছে না।তার বাবা মা বিশেষ করে বাবা খুবই বিরক্ত লজ্জিত। কিন্তু যখন দেখা গেল তাকে ভালো বেসে যেভাবে পড়ালো তাতে করে সে তার শিক্ষার উঁচুস্তরেই পৌঁছে গেল।আর এখানে নাট্যকার একজন শিক্ষকের যে শিক্ষনীয় পদ্ধতি এটাকেও বোঝাতে পেরেছেন উনার শিক্ষা দেওয়ার  ভূমিকা দেখিয়েছেন।আর যখন তাঁর ভেতরের সততার খবর  পত্রপত্রিকায় বা স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে এতে করে তার বাবা মা খুব খুশি হয়ে যায় এবং বুঝতে পারে আসলে আমাদের প্রকৃত মানুষ হওয়া উচিত।মা বাবা গুবলুকে নিয়ে খুবই চিন্তিত ছিল কিন্তু একদিন গুবলুই তাদের সবার মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলে। নিজে অনেক সময় খুব স্যাড থাকতো পরীক্ষায় পাশ করতো না বলে কিন্তু কোন একদিন আস্তে আস্তে এগুলো দূর হয়ে যায়। এখানে নাট্যকার তার ভেতর যে মানুষকে সাহায্য করার এবং সততার  নিদর্শন রেখেছে এটাও আমাদের শিক্ষা। আসলে হাসি ও কান্না এই দুটি মানুষের জীবনকে বদলে দিতে পারে। এখানে গুবলো প্রথমে কান্না করে,বা মন খারাপ করে কারণ তার পরীক্ষায় রেজাল্ট ভালো আসছে না। এরপর যখন এক সাধু ওকে দেখে বলল যে তুমি খুব ভালো সবসময়ই হাসিমুখে থাকবে সবার সাথে হাসি দিয়ে কথা বলবে। এরপর থেকে সে সবার সাথে হাসি দিয়ে কথা বলে এবং এতে করে তার সমস্ত কিছুই পরিবর্তন হয়ে যায়। এতে করে তার জীবনের পুরো ঘটনাটাই চেঞ্জ হয়ে গেছে। আসলে একটা হাসি দিয়ে কথা বলা অনেক অসাধারণ কিছুও সাধারণ হয়ে যায়। নাটকে বড় খুকি ও ছোট খুকি ও ওদের বাবা ভালো অভিনয় করেছে। অনিকেত চক্রবর্তী, আশিস বিশ্বাস, শ্যামলীমা দে এবং সোহাশ দত্ত ভালই তাদের চরিত্র অনুযায়ী সঠিকভাবে দর্শকের সামনে উপস্থাপন করতে পেরেছেন। বাকিরা চরিত্র অনুযায়ী মোটামুটি ভাবে সফল। মঞ্চে আশীষ বিশ্বাস, সৌমেন্দ্র নন্দী আবহে, ও রূপসজ্জায় তপন কর্মকার যথাযথ ভাবেই উনারা প্রয়োগ করেছেন। আলো মোটামুটি ভাবে মানানসই ভাবে সঞ্জয় দাস দিয়েছে। নন্দন তৃষা দর্শকদের মোটামুটি ভাবে পরিচ্ছন্ন একটি উপস্থাপনা উপহার দিয়েছেন।