img

নাট্যভূমি গ্রুপ থিয়েটারের নাটকঃ " রাংচাক নি খুম্পুই' মানবিক সংহতির আকাঙ্খা


নারায়ণ দেব


১০ মে, ২০২৫ ( দ্বিতীয় শনিবার) সম্মিলিত নাট্য প্রয়াসের উদ্যোগে নাট্যভূমি গ্রুপ থিয়েটার রবীন্দ্র ভবনের ২নং হলে উপস্থাপিত করল তাদের নবতম প্রযোজনঃ " রাংচাক- নি- খুমপুই" ( স্বর্ণালী দোলন চাঁপা)। রচনাঃ মধুমিতা নাথ, নির্দেশনাঃ পার্থপ্রতিম আচার্য।
 ফোল্ডারে লেখা হয়েছে নাটকটি শূদ্রক বিরচিত সংস্কৃত ক্লাসিক " মৃচ্ছকটিক"-এর  আঞ্চলিক বিনির্মান।
  খৃষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে রচিত হয় মৃচ্ছকটিক। মৃচ্ছকটিক মানে একটি ছোট মাটির গাড়ি। মৃচ্ছকটিক নাটকের সারসংক্ষেপ হল এইরূপঃ
উজ্জয়িনীর বারবনিতা বসন্তসেনা বণিক চারুদত্তের প্রতি আকৃষ্ট। অন্যদিকে রাজশ্যালক লম্পট, দুষ্ট চরিত্রের শকার বসন্তসেনার প্রতি প্রণয়প্রার্থী। বসন্তসেনা অবশ্য শকারকে আদৌ পছন্দ করেন না। বসন্তসেনাকে না পেয়ে ক্রুদ্ধ, ক্ষুব্ধ শকার ক্ষিপ্ত হয়ে তার গলা টিপে ধরলে বসন্তসেনা মূর্ছিত হয়ে পড়েন। শকার তাকে মৃত ভেবে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে চারুদত্তকে মিথ্যাভাবে হত্যায় অভিযুক্ত করে রাজার সাহায্যে অন্যায়ভাবে তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করায়। এদিকে বসন্তসেনার জ্ঞান ফিরলে চারুদত্তকে বাঁচাতে তিনি বধ্যভূমিতে যান। অন্যদিকে আর্যক উজ্জয়িনী অধিকার করে অত্যাচারী রাজা পালককে সিংহাসনচ্যুত করেন। আর্যকের একসময়ে উপকারী চারুদত্ত রাজ্যখণ্ড ও প্রধানমন্ত্রীত্ব পেয়ে বসন্তসেনাকে বধুর মর্যাদা দিয়ে ঘরে নিয়ে আসেন।
 রাংচাক- নি - খুম্পুই নাটকের প্রেক্ষাপট ত্রিপুরার টিলাভূমি। সময়- সুদূর অতীত যেখানে ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের মিশেলে গড়ে উঠেছে এক নতুন কাহিনি। নাটকের কেন্দ্র বিন্দুতে রয়েছে হামজাকমা ও লারিমার নিষ্পাপ প্রেম। রয়েছে বাঈকতর নামের এক স্নেহময়ী নারী।  যিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে উঠতে জানেন। অন্যদিকে  রয়েছে থাইলাফ্রুর মতন খল চরিত্র। যে ছলে বলে কৌশলে পেতে চায় লারিমাকে। এবং না পেয়ে লারিমাকে নির্মম ভাবে হত্যা করে। পরবর্তীতে হামজাকমার বিরুদ্ধে লারিমাকে হত্যার মিথ্যা রটনা দিয়ে বিচার বসায়। কিন্তু বাঈকতরের নেতৃত্বে সে চক্রান্ত ভেস্তে যায়। সর্দারের বদল হয় নতুন সকাল শুরু হয় সহজ - সরল  প্রকৃতি প্রেমী মানুষদের জীবনে।  নাটকটি পারিপার্শ্বিক বাস্তবতার পাশাপাশি সমাজের অন্তর্দ্বন্তকে অতিক্রম করে ন্যায় এবং মানবিক সংহতির আকাঙ্ক্ষাকে তুলে ধরে।
 বিনির্মান বলতে আমরা বুঝি কোন পুরাতন জিনিষকে নতুন করে পুনরায় তৈরী করা।
   এই  নাট্য কাহিনিটিতে সম্পূর্ণ রূপে তা পালিত হয়েছে কি? এই প্রশ্নটি থেকেই গেল। 
মধুমিতা নাথ রচিত নাট্য কাহিনির বুনটে, সংলাপ রচনায় এবং নাটকীয় উপাদানের অভাবে নাট্যচলন বারবার হোঁচট খেয়েছে। পার্থপ্রতীম আচার্যের নির্দেশনায় রয়ে গেছে কিছুটা ফাঁক ফোঁকর। যা "সরল বার্তা", ”ওয়াকসা", "ভেঁপু" সহ আরও অনেক মঞ্চ সফল নাটকের নির্মাতার কাছে আশাতীত। তাঁর মঞ্চ বিন্যাসে খামতি থাকায় নাটকের  প্রেক্ষাপটে তিনি যে ক্রিয়াগুলি উপস্থাপিত করতে চেয়েছেন, তা ভীষন ভাবে আ্যমেচারিশ হয়ে দাঁড়ায। সবচেয়ে বড় বাঁধা হযে দাঁড়ায় প্রায় প্রতিটি অভিনেতার স্বর নিক্ষেপ, সংলাপ উচ্চারন এবং প্রক্ষেপন এতটাই অপটু যে, সংলাপের মজাটাই দর্শকের কাছে সঠিক চেহাড়ায় পৌঁছুতে পারে না। এই ধরনের নাটক এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য অভিনেতাদের জন্য যে দক্ষতার প্রয়োজন এবং স্ক্রিপ্টের যে তীক্ষ্ণতা প্রয়োজন তা খুব সহজ কাজ নয়। এ ক্ষেত্রে নির্মম ভাবে স্ক্রিপ্টটির সম্পাদনার প্রয়োজন অনুভূত হয়েছে।
অভিনয়ে আলাদা করে উল্লেখ করতে হয় মধুমিতা নাথের নাম। তিনি তাঁর সুদক্ষ অভিনয়ে চরিত্রটির মাতৃস্নেহ এবং প্রতিবাদী সত্বাটিকে রূপায়িত করেছেন। থালাইফ্রু চরিত্রে সুরজিৎ দাস একটি অন্য মাত্রা যোগ করেছেন। তাঁর বিশেষ ধরনের টিউনিং এবং শারিরিক অভিনয় চরিত্রটিকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। খুমপুই চরিত্রে সাথী মালাকার যেন এক ঝলক স্নিগ্ধ বাতাস। অন্যান্য চরিত্রে অভিনয় করেছেনঃ  খুমতিয়াঃ প্রতিশ্রুতি দাস, ফানকরকঃ সুমন মজুমদার, নখাঃ তৃষাণ দেব, থৈসাঃ তন্দিম বনিক, সুব্রাইঃ সরজিৎ দেব, বৌদ্ধভিক্ষুঃ সৌম্যদীপ্ত বোস, কর্তাঃ বিক্রম রায় চৌধুরী, কোরাসঃ প্রভাত রুদ্রপাল, উৎপল সরকার, সপ্তমী, অনন্যা অনুপম দত্ত, রিতিকা রায় ও অজন্তা চৌধুরী।
 এই নাটকের আলোক সাজে ছিলেন প্রদীপ দাস, আবহ  নির্মানে ছিলেন সৌম্যেন্দ্র নন্দী এবং রূপসাজে ছিলেন পীযূষ কান্তি রায়। আলো,  আবহ এবং রূপসজ্জ্বা  অত্যন্ত উন্নতমানের।  যা প্রযোজনাটির  দুর্বল দিকগুলিকে ঢেকে নাটকটিকে সুঠাম চলন দিয়েছে।
মঞ্চ পরিকল্পনাঃ শুভ্রজিৎ পাল, নির্মাণঃ রাজেশ কান্তি সাহা নাট্যানুসারি। তবে দৃশ্যান্তরে মঞ্চের উপকরন আনা নেওয়ায় কাজটি আরও দ্রুততার সাথে করতে হবে।  মঞ্চ সজ্জ্বায় লাউড রংয়ের ব্যবহারের   ফলে কোথাও কোথাও মঞ্চে থাকা চরিত্র গুলির উপস্থিতি ম্লান হয়ে যায়। পোষাক পরিকল্পনায় ছিলেনঃ আপ্রোদিতি। পোষাকের চাকচিক্য নিয়ে আরেকটু চিন্তা ভাবনার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। পরিশেষে একটি কথা অবশ্যই বলতে হয় নানাবিধ ত্রুটি সত্বেও পরিচালকের অভিজ্ঞতা ও নাট্য ভাবনার প্রয়োগের ফলে সমগ্র নাট্যটি উপভোগ্য হয়ে ওঠে।
 একটি বিষয়ে নাট্যভূমি গ্রুপ থিয়েটার সাধুবাদ পেতেই পারে।  তা হল মঞ্চে নতুন প্রতিভা তুলে আনা। পরিচয় পর্বে পরিচালকের কথা থেকে জানা গেল অভিনেতাদের সিংহ ভাগই নাট্য মঞ্চে এই প্রথম কাজ। যদিও তিনি এটাও বলেছেন প্রায় তিন মাস কর্মশালার ফলশ্রুতিতে এই নাট্য নির্মাণ। তবে এই কথা নিশ্চিত করেই বলা যায় প্রথম প্রযোজনার ত্রুটি বিচ্যুতি গুলি সারিয়ে নাট্যটি আগামীতে একটি মঞ্চ সফল প্রযোজনা হয়ে উঠবে।